জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের অবস্থা

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প বিশ্বব্যাপী সস্তায় পোশাক রপ্তানির জন্য পরিচিত। এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে নিম্ন মজুরি, খারাপ কাজের পরিবেশ এবং নারী শ্রমিকদের ওপর অস্থিতিশীল নির্ভরতা।

গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের দ্রুত উন্নতি শুরু হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে পোশাক রপ্তানি মোট রপ্তানির মাত্র ৪% ছিল, কিন্তু ২০২২-২৩ সালে এটি বেড়ে ৮৪% হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ (চীনের পরে)। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে, যাদের ৮০% নারী বলে দাবি করা হয়।

গার্মেন্ট শিল্পের সাফল্যের পেছনের কারণ
  • বৈশ্বিক চাহিদা: ১৯৭৪ সালের মাল্টি-ফাইবার অ্যাংলিমেন্ট (MFA) এশিয়ার অন্যান্য দেশের রপ্তানিতে কোটা বসায়, ফলে কোরিয়া ও অন্যান্য দেশ বাংলাদেশে উৎপাদন শুরু করে।
  • বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নীতি: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উদারীকরণ করে, রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সুবিধা দেয় (যেমন ডিউটি-ফ্রি জোন, বন্ডেড গুদাম)।
  • সস্তা শ্রম: বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হলো বিশ্বের সর্বনিম্ন মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ। বর্তমানে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১২,৫০০ টাকা (প্রায় ১১৩ ডলার), যা প্রকৃত জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি (প্রায় ৪৬০ ডলার) থেকে অনেক কম।
নারী শ্রমিকদের অবস্থা

গার্মেন্ট শিল্পে নারীদের কর্মসংস্থানকে নারী ক্ষমতায়নের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু বাস্তবে:

  • মজুরি বৈষম্য: নারীদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম।
  • স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির প্রভাব: জ্যাকার্ড মেশিনের মতো প্রযুক্তির কারণে নারীদের চেয়ে পুরুষ শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে, ফলে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে।
  • কাজের পরিবেশ: দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সাধারণ।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব

মহামারির সময় বহু আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড অর্ডার বাতিল করায় হাজারো কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকদের বেতন বাকি পড়ে। প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শ্রমিক আন্দোলন ও দমন

১৯৯৪ থেকে এখন পর্যন্ত ৬ বার ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই শ্রমিক আন্দোলন দমন করা হয়েছে। সরকার ও BGMEA (বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) প্রায়শই শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে দুর্বল করতে চাপ দেয়।

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর শ্রমিকদের জন্য নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার শ্রম সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করেছে। তবে, গার্মেন্ট শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন:

  • ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা
  • শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার সুরক্ষা
  • আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলির সাথে চুক্তির ভারসাম্য আনা
উপসংহার

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প নারী ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক হলেও এর অন্ধকার দিকগুলো উপেক্ষা করা যায় না। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিবর্তন প্রয়োজন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart